কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ। যারা আল্লাহপাকের একত্ববাদে বিশ্বাসী, যারা তাকে পালনকর্তা, লালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা হিসেবে অন্তরের অন্তঃস্থলে পরম যত্নের সঙ্গে স্থান দিয়েছেন, তারাই তার ইবাদতকে পরম সৌভাগ্যের বিষয় হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। সেই আল্লাহর নামে নিজ অধিকারের কোনো বস্তুকে উৎসর্গ করা। মনে রাখতে হবে, এ উৎসর্গের মূল্যায়ন আর্থিকভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না। হয় একমাত্র আল্লাহভীরুতার ওপর। কোরবানি একমাত্র আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে। কোরবানি শব্দটি 'কুরব' থেকে এসেছে, যার অর্থ নৈকট্য, সানি্নধ্য ও নিকটবর্তী হওয়া। কোরবানির মাধ্যমে কোনো কিছু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া ।
মানব জাতির পিতা হজরত আদম (আঃ)-এর সময় থেকেই এই কোরবানি চালু হয়ে এসেছে। সে সময় কোরবানির অন্য নিয়ম প্রচলিত ছিল। কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট বস্তু বা জন্তুকে কোনো একটি উঁচু স্থান বা পাহাড়ে রেখে আসা হতো। যার কোরবানি আল্লাহপাক কবুল করতেন, সেই বস্তু বা জন্তুটিকে আকাশ থেকে একটি আগুনের ফুলকি এসে জ্বালিয়ে দিত। আর যে কোরবানিটি আল্লাহপাক কবুল করতেন না, সেটি সেভাবেই পড়ে থাকত। তখন কোরবানির মাংস খাওয়া যেত না, সম্পূর্ণটাই উৎসর্গ, সুতরাং পুড়ে যেত। পরে আল্লাহপাক এই নিয়ম বাতিল করেন এবং কোরবানির পশুর মাংস খাওয়া জায়েজ করেন।
হজরত আদম (আঃ)-এর সন্তান জন্ম নিত জোড়ায় জোড়ায়। একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। তাদের মধ্যে বিয়ে হতো এক জোড়ার মেয়ের সঙ্গে অন্য জোড়ার ছেলের। কিন্তু কাবিলের সঙ্গে যে মেয়ে ছিল সে সুন্দরী না হওয়ায় আর তার সঙ্গের মেয়েটি সুন্দরী হওয়ায় সে জিদ ধরল সে তার জোড়ার মেয়েকেই বিয়ে করবে। এই নিয়ে হাবিল আর কাবিলের মধ্যে শুরু হয় বিবাদ। এই বিবাদ মীমাংসার জন্য পিতা হজরত আদম (আঃ) বললেন, তোমরা আল্লাহপাকের দরবারে কোরবানি পেশ কর। আল্লাহপাক যার কোরবানি কবুল করবেন, তার সঙ্গেই আকলিমার বিয়ে হবে। পিতার সিদ্ধান্তে একমত হয়ে হাবিল একটি দুম্বা আর কাবিল কিছু ফল-ফসল একটি পাহাড়ের চূড়ায় রেখে এলো। তখন আসমান থেকে একটি আগুনের ফুলকি এসে হাবিলের কোরবানিটি ছাই করে দিল। আর কাবিলের কোরবানি অবিকল পড়ে রইল। এতেই প্রমাণিত হলো যে, কাবিলের সঙ্গে আকলিমার বিয়ে হতে পারে না। কোরআনে কারীমে কউমে আদ এবং অন্যান্য কউমের কোরবানির কথাও বলা আছে।
তবে আমরা মুসলমানরা মূলত মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সুন্নত অনুসরণ করি। আল্লাহপাক তাকে অনেকভাবে পরীক্ষা করেছেন। আল্লাহ তাকে ৯০ বছর পর্যন্ত কোনো সন্তানাদি দেননি । তারপর তাকে আল্লাহ একটি সুসন্তানের সুসংবাদ দান করেন। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং তার স্ত্রী সম্পূর্ণ অবাক হয়ে যান। ফেরেশতাদের দ্বারা এই সংবাদ পেয়ে তারা প্রশ্ন করেন, তা কি করে সম্ভব? তখন ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) উত্তর দেন, আপনার পালনকর্তার কাছে এটা অসম্ভব কিছু নয়। তারপর সন্তান হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই হজরত ইব্রাহীম (আঃ) অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হন এবং সন্তানকে খুব ভালোবাসতেন। আল্লাহ তখন পরীক্ষা করতে চাইলেন, ইব্রাহীম আমাকে বেশি ভালোবাসে না তার সন্তানকে। তাই তিনি তাকে স্বপ্ন দেখান তার প্রিয় জিনিস কোরবানি দিতে। ইব্রাহীম (আঃ) অনেক পশু কোরবানি দেওয়ার পরও একই স্বপ্ন বারবার দেখার পর বুঝলেন আল্লাহপাক তার ছেলেকে কোরবানি দিতে বলছেন। তিনি ইসমাঈল (আঃ) কে নিয়ে রওনা হলেন, তখন পথে শয়তান ইসমাঈল (আঃ)কে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তিনি পাথর ছুঁড়ে মারেন। ইব্রাহীম (আঃ) যখন তার ছেলেকে তার অভিপ্রায়ের কথা জানালেন, তিনি উত্তর দেন পিতা আপনাকে আল্লাহ যা আদিষ্ট করেছেন আপনি তা পালন করেন, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্গত হিসেবে পাবেন। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে নিজের চোখ কাপড় দিয়ে বন্ধ করে ধারালো ছুরি দিয়ে ছেলেকে কোরবানি করার চেষ্টা করেন। ওদিকে আল্লাহপাক ছুরিকে নিষেধ করে দেন ইসমাঈল (আঃ)কে কাটতে। ফলে এত ধারালো ছুরি দিয়ে তিনি বারবার চেষ্টা করেও কাটতে পারেননি। তখন মনের দুঃখে ছুরি ছঁড়ে মারেন। ছুরি পাথরের উপর পড়ে পাথর খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। আল্লাহ ইব্রাহীম (আঃ)-এর ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং বেহেশত থেকে ফেরেশতা দ্বারা দুম্বা পাঠিয়ে দেন কোরবানি করার জন্য; আর বলেন, ইব্রাহীম তুমি তোমার দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ আর আমি তোমার কোরবানি কবুল করেছি। তুমি ইসমাঈলের বদলে দুম্বা কোরবানি কর। ইব্রাহীম (আঃ)-এর অপূর্ব আত্মত্যাগের কারণে আল্লাহপাক তাকে জাতিসমূহের নেতা করেছেন এবং আমরা প্রতি নামাজে দরুদের মাধ্যমে তার প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করি।
সুতরাং আমাদেরকেও আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করতে হবে। কোরবানি করার জন্য নির্দেশ রয়েছে সূরা কাউসারে। আল্লাহপাক বলেছেন, আপনি রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। কোরবানি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, 'কোরবানি দিনের পছন্দনীয় আল্লাহপাকের নিকট অন্য কোনো দিন নয়। উক্ত দিনে কোরবানি করা সমস্ত নেক কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। কোরবানির জন্তুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই তা আল্লাহপাকের নিকট কবুল হয়ে যায়'। তিনি আরও বলেন, 'কোরবানির জন্তুর শরীরে যত লোম আছে প্রতিটি লোমের পরিবর্তে একটি করে নেকি তার আমলনামায় লিখে দেওয়া হয়'। রাসূলে পাক (সাঃ) আরও বলেন, 'যে ব্যক্তি সামর্থথাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমার মুছল্লায় (ঈদের জামাত) না আসে'। প্রতিটি সামর্থ্যবান লোকের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। যাকাত পরিমাণ মাল থাকলে কোরবানি দিতে হবে। মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয় না।