Monday, 9 April 2012

মৃত্যুর বিভীষিকা -২ : একজন মুমিন বান্দা ও একজনকাফিরের মৃত্যু

                            بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيم 

 হযরত আনাস (রা), হযরত তামীম দারী (রা) এর রেওয়ায়েতে বলেন, রাসূল্লুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ ফরমান, আল্লাহ তায়ালা মালাকুল মউতকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার বন্ধুর কাছে যাও এবং তাকেনিয়ে এসো। আমি তাকে সুখ দুঃখ দিয়ে ঐ জায়গাতেই পেয়েছি যেখানে আমার সন্তুষ্টি ছিল। অর্থাৎ সে ঈমানের উপর অটল ছিল। এবার তুমি তাকে আমার নিকটে নিয়ে এসো, যাতে আমিতাকে দুনিয়ার দুঃখ যাতনা থেকে মুক্তি দিতে পারি।a
নির্দেশ পেয়ে মালাকুল মাউত পাঁচশত ফেরেশতার বিশাল বাহিনী নিয়ে তার কাছে যায়। ফিরিশতাদের নিকট জান্নাতের সুগন্ধি ও কাপড় থাকে, হাতে থাকে ফুলের সাজানো তোড়া এবং শুভ্র বর্নের রেশমি পরিধেয়। বস্ত্রগুলোতে মেশকের সুগন্ধি ছড়ানো থাকে। এভাবে সুসজ্জিত হয়ে মালাকুল মউত ঐ বান্দার সামনে এসে বসে যায়। অপরদিকে সাথের ফিরিশতারা তাকে ঘিরে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যে,তাদের প্রত্যেকের হাত মুমিনের কোন না কোনো অঙ্গে জড়িয়ে থাকে। অতঃপর তাদের সাথে নিয়ে আসা শুভ্র রেশমি বস্ত্রটি তার থুতনির নিচে বিছিয়ে দেয়া হয়।এরপর তার দৃষ্টির সামনে জান্নাতেরএকটি দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। রাসূল্লুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান, এই সময় জান্নাতের মূল্যবান বস্তুগুলো যেমন হুর, পোশাক এবং রকমারি ফল দিয়েতাকে প্রলোভন দেখানো হয়। প্রলোভনটি এমন হয় ঠিক যেমন অবুঝ শিশু কান্নাকাটি করলে তার অভিভাবকরা তাকে খেলনার বস্তু দেখায়। জান্নাতে তার সহধর্মিনিরা তখন খুবই পুলকিত থাকে, এ দৃশ্য দেখে মুমিন বান্দার আত্মা তখন লফিয়ে উঠে।
মালাকূল মউত তখন বলে- হে পবিত্র আত্মা ! তুমি বের হয়ে আস কাঁটা বিহীন বদরিকা বৃক্ষে, কাঁদি কাঁদি কলায়। দীর্ঘ ছায়ায়, প্রবাহিত পানিতে ও প্রচুর ফল মূলে। রাসূল্লুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এও ফরমান যেমালাকুল মউত তখন ঐ মুমিন বান্দার সাথে তার মা বাবার চাইতেও কোমল আচরণ করেন। কেননা সে জানে যে এই আত্মা আল্লাহ তায়ালার নিকট খুবই প্রিয় ও সম্মানী। তাই সেও এই বান্দার সাথে কোমল আচরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়। সে নেক বান্দার আত্মা এত সহজে বের করে নিয়ে সে যে, যেন আটার মধ্য থেকে নিক্ষিপ্ত পশম বের করে নিয়ে আসে। অবশেষে আত্মা যখন বের হয়ে আসে তখন চতুর্দিক থেকে ফেরেশতরা এই বলে চিৎকার করে উঠে যে, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তুমি তোমার নেক আমলের কল্যাণে জান্নাতে প্রবেশ করে নাও। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
“ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করেন তাদের পবিত্র অবস্থায়, ফিরিশতারা বলে, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক”। (সূরা নাহল-৩২)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, “যদি সে নৈকট্যশীলদের একজন হয় , তবে তার জন্যে আছে সুখ, উত্তম রিযিক এবংনিয়ামত ভরা উদ্যান”। (সূরা ওয়াকেয়া-৮৮-৮৯)
মালাকুম মউত যখন আত্মা কবজ করে নেন, তখন আত্মা দেহকে বলে, হে দেহ ! আল্লাহ তোমাকে সুপ্রতিদান দিক। তুমি আমার সঙ্গী হয়ে আল্লাহর আনুগত্যে অগ্রগামী ছিলে।আর আল্লাহর অবাধ্যে ছিলে খুবই পশ্চাৎপদ। তুমি আমার পক্ষ থেকে মুবারকবাদ গ্রহণ কর।
কেননা আজ তুমি নিজেও মুক্তি পেয়েছো আর আমাকেও নাজাত দিয়েছ। এভাবে দেহও আত্মাকে মুবারকবাদ দেয়। মুমিন বান্দার মৃত্যুতে যমীনের যে সকল অংশে সে ইবাদত করত সেগুলো কাঁদতে থাকে। আকাশের যে সকল দুয়ার দিয়ে তার নেক আমল উপরে উঠত সে সকল দুয়ার তার জন্যে কাঁদতে থাকে। যে দরজা দিয়ে তার রিযিক নেমে আসত সে দরজাও কাঁদতেথাকে। আকাশ যমীনের এ ক্রন্দন দীর্ঘ চল্লিশ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
মালাকুল মউত যখন তার আত্মা কবজ করে নেয় তখন তার দেহের হেফাযতের জন্যে সেখানে পাঁচশত ফেরেশতা দাঁড়িয়ে থাকে। যদি কেউ তার লাশের পাশ ফিরাতে চায় তখন ফিরিশতারাও এ কাজে মানুষের সহযোগিতা করে। এমনকি কাফন পরিধান ও সুগন্ধি মাখানোর কাজেও ফিরিশতারা অংশ নেয়। লাশের সম্মানার্থে ফিরিশতারা দুটি সারি করে ঘর থেকে কবর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়। জানাযা যখন অতিক্রম করে তখন তারা অভ্যর্থনা জানায়। তার জন্যে ক্ষমার প্রার্থনা করে। মুমিনের মর্যাদার এ অবস্থা দেখে ইবলিশ এত জোরে চিৎকার করে উঠে যে, তার দেহের হাড়ের কোন কোন গ্রন্থির বন্ধন এ সময় ছিঁড়ে যায়। সে আক্ষেপের সাথে তার সঙ্গীদের বলতে থাকে তোমাদের সর্বনাশ হোক। এই বান্দা তোমাদের ফাঁদ থেকে কিভাবে ফসকে গেল। ইবলিশের সঙ্গীরা বলে, এ নিষ্পাপ ছিল তাই আমাদের ফাঁদে আটকায়নি।
মালাকুল মউত যখন তার আত্মাকে নিয়ে আকাশে আরোহন করে তখন হযরত জিবরাইল (আ) সত্তর হাজার ফিরিশিতা নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। আর সকল ফিরিশতারা তার নিকট আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির সুসংবাদ জানাতে থাকে। মালাকুল মউত যখন আত্মাটিকে নিয়ে আরশের নিকট পৌঁছেন তখন সেআল্লাহ তায়ালার সামনে সিজদায় পতিত হয় যায়। আর সে সময় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে মালাকুল মউত ! তুমি আমার বান্দাকেনিয়ে জান্নাতের বাগানে রেখে এস। অতঃপর তাকে কবরেরাখার পর নামায তার ডান দিকে এবং রোযা তার বামদিকে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহর যিকর ও কুরআন তিলাওয়াত এসে দাঁড়িয়ে যায় তার শিথানের দিকে। পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে যায় জামাতের সাথে নামায পড়ার জন্য মসজিদের দিকে গমন। আর তারধৈর্য্য কবরের এক কোনায় অবস্থান নেয়। এ সময় আল্লাহ তায়ালা তার কবরে আযাবের একটি অংশ প্রেরণ করেন। আযাবটি এসে কবরে ডানদিকে থেকে প্রবেশ করতে চায়।
কিন্তু নামায তাকে বাধা দিয়ে বলে- আযাব তুমি পিছিয়ে যাও। খোদার কসম ! এই বান্দাটি সারা জীবন কষ্টে ছিল। কবরে আসার পর তার কিছুটা আরাম মিলেছে।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান, আযাবতখন ডান দিকে থেকে সরে বাম দিকে যায়। বাম দিকে রোযা নামাযের মত আযাবকে জবাব দিয়ে প্রতিহত করে।আযাব এবার মাথার দিক থেকে আসতে চেষ্টা করলেও একই রকম জবাব আসে। মোট কথা আযাব যেদিক থেকেই আসতে চায় সেদিক থেকেই তারজন্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
অবশেষে আযাব যখন দেখে আল্লাহর এই নেক বান্দার আমল সব দিক থেকেই তার জন্যে প্রতিরক্ষার দেয়ালসৃষ্টি করে রেখেছে তখন সেফিরে যায়। আর সে সময় ‘সবর’উঠে নেক আমল সমূহকে বলতে থাকে, এই আযাবের প্রতিরক্ষায় আমি এজন্যে আসিনি যে মূলত তোমাদের শক্তির পরিমাণ দেখা আমার উ
তোমরা যদি তাকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতে তাহলে আমি অবশ্যই এসে এই বান্দাকে আযাব থেকে রক্ষা করতাম। তোমরাই যখন যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ালে তখন আমি এই বান্দার জন্যে অতিরিক্ত সঞ্চয় হয়ে রয়ে গেলাম। পুলসিরাত আর মিযানে আমি তার কাজে আসব।
এরপর ঐ বান্দার নিকট এমন দুজন ফিরিশতা আসে যাদের চোখ নীল বর্ণের। আওয়াজ ভয়ংকর। গরুর শিংগের ন্যায় দাঁত এবং তাদের শ্বাসের সাথে নাসা রন্ধ্র দিয়ে অগ্নি শিখা বের হয়। ফিরিশতাদ্বয়ের উভয় কাঁধের মধ্যবর্তীস্থান খুবই প্রশস্ত। তারা মুমিন বান্দা ছাড়া আর কারো উপর দয়া করতে জানে না। এই দুজন ফিরিশতাদেরকেই মুনকার নাকির বলা হয়। ওদের হাতে একটি হাতুড়ি থাকে। এটি এতই ভারি যে সকল মানব-দানব মিলে একত্রিত হলেও তা উত্তোলন করতে সক্ষম হবে না। এ দুজন ফিরিশতা কবরে প্রবেশ করে লাশকে বলে উঠেবসো। লাশ তৎক্ষণাৎ উঠে বসে যায় এবং কাফনের কাপড় খুলে পড়ে যায়।
ফিরিশতা তখন জিজ্ঞেস করেন, তোমার প্রভূ কে?
তোমার ধর্ম কি ?
এবং তোমার নবী কে?
জবাবে সে বলে, আমার রব হলেন আল্লাহ যার কোন অংশীদার নেই। আমার ধর্ম ইসলাম। আর হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন আমার নবী। তারপর আর কোন নবীর আগমন হবে না।
ফিরিশতা জবাব শুনে বলেন, তুমি সত্য বলেছ। অতপর কবরকে চারদিকে থেকে প্রশস্ত করে বলেন , তুমি উপরের একটু দিকে তাকিয়ে দেখ। সে উপরে তাকায়। তখন আকাশের শেষ সীমানাতক তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বন্ধু ! এটা তোমার অবস্থানের ঠিকানা।আল্লাহর আনুগত্যের বিনিময়ে তুমি এটা পেয়েছ।
বর্ণনার এই পর্যায়ে এসে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বলেন, ওই সত্তার কসম যার মুঠোয় আমার প্রাণ। মুমিন বান্দার তখন এতই আনন্দ অনুভূত হয় যা কখনো শেষ হবার নয়। অতঃপর ঐ বান্দাকে আবার নির্দেশ দিয়ে বলা হয় যে, তুমি নিচের দিকে দেখ। নিচের দিকে যখন সে তাকায় তখন দোযখের শেষ সীমানা পর্যন্ত তার দৃষ্টির গোচরে চলে আসে। ফিরিশতা তখন তাকে বলে, হে আল্লাহরপ্রিয় পাত্র ! এই ভয়াবহ নরক থেকে তুমি নাযাত পেয়েছ। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন,ওই বান্দার এ সময় এমন পুলকানুভূতি অর্জিত হয় যা কখনো সমাপ্ত হবার নয়। অতঃপর স্বর্গের সাতাত্তরটি দরজা তার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এসব দুয়ার দিয়ে জান্নাতের সৌরভ এবং সুশীতল সমীরণ তার কবরে পৌঁছতে থাকে এবং ততদিন পৌঁছতে থাকবে যতদিন সে কবরে থাকবে।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলোচনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে বলেন, এরপর আল্লাহ তায়ালা মালাকুল মউতকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার দুশমনের নিকট যাও এবং তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি প্রাচুর্য্যের সাথে তাকে রুযি দিয়েছি। সীমাহীন নিয়ামতের বারিপাত করেছি তার উপর। কিন্তু সে আমার সাথে শুধুঅবাধ্যতাই করে ফিরেছে। এবার এই দুশমনকে আমার কাছে হাজির করো।
মালাকুল মউত আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে এমন কদাকার বেশে ঐ বান্দার নিকট আগমনকরে যে, কেউ কোনো দিন এমন আকৃতি দেখেনি। তার বারটি চোখ থাকে। তার কাছে এমন একটি লৌহ শলাকা থাকে যা শাখা ও কাঁটা বিশিষ্ট। মালাকুল মউতের সাথে আরো পাঁচশত ফিরিশতা থাকে। এদের প্রত্যেকের সাথেই থাকে জাহান্নাম থেকে নিয়ে আসা আগুনের চাবুক। মালাকুল মউত অবাধ্য বান্দাকে চাবুক দিয়ে এমনভাবে আঘাত করে যে, প্রতিটি কাঁটা তার সারা দেহে তন্ত্রের মূলে বিদ্ধ হয়ে যায়। অতঃপর সেটি পাকিয়ে টেনে বের করেএবং তার পায়ের নখের তলদেশথেকে পর্যন্ত আত্মাকে বের করে নিয়ে আসে। এরপর সেই লৌহ শলাকাটি তার উভয় পায়ের গোড়ালিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তখন আল্লাহর এই দুশমনের এতই কষ্ট হয় যে , বেদনায় সে কাতরাতে থাকে। এমন সময় বাকি ফিরিশতারা তাদের হাতের চাবুক দিয়ে তার মুখমন্ডল এবং পশ্চাৎদেশে অনবরত প্রহারকরতে থাকে। এ সময় তার আত্মাকে টেনে সারা দেহ থেকে গোড়ালিতে নিয়ে আসা হয়। শাস্তির এই পর্যায়ে শলাকাটি তার হাঁটুতে ফোটানো হয়। তখন বেদনায় সেছটফট করতে থাকে। এমন সময় ফিরিশতারা আবার আগুনের চাবুক দিয়ে তার মুখ ও নিতম্বে মারতে শুরু করে। হাঁটু থেকে শলাকাটি বের করে ঢুকানো হয় তার নিতম্বদেশে। অতঃপর বুকে এবং সব শেষে কন্ঠনালীতে, তারপর পূর্বের মতই সেটিকে টেনে বের করা হয়। এরপর ফিরিশতারা জাহান্নাম থেকে সংগ্রহ করা অঙ্গার তার থুতনীর নিচে বিছিয়ে দিয়ে বলে, হে অপবিত্র আত্মা ! তুমি বেরিয়ে আস।
“তুমি থাকবে প্রখর বাষ্পে, উত্তপ্ত পানিতে, এবং ধুম্রকুঞ্জের ছায়ায়।যা শীতল নয় এবং আরামদায়কওনয়”। (সূরা ওয়াকেয়া ৪২-৪৪)
(মুসনাদে আবি ইয়ালা, ইবন আবি দুনিয়া থেকে সংগৃহিত)
দ্দেশ্য ছিল।

0 comments

Post a Comment

Thanks for comment