Thursday 12 April 2012

এক দুখিনী নারীর গল্প

                                     بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيم




সত্তর দশকের শুরুলগ্নের কথা। তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়উজ্জীবিত দেশবাসী। দেশজুড়ে কেবল যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে গোপালগঞ্জ জেলার অদূরে অবস্থিত কাজুলিয়া গ্রামের এক দারিদ্রপীড়িত পরিবারেজন্ম নেয় পারভীন। জন্মের কিছুদিন পর বাবামারা যাওয়ায় লেখাপড়ায় তেমন হাতেখড়ি হয় নি তাঁর। অভাবী সংসারে কোনমতে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে সে। কিশোরীর দ্বারপ্রান্তে যখন, তখনচাচা ডা. আ. জলিল পাশের গাঁয়ের মান্নু মুন্সী’র সঙ্গে তাকে বিয়ে দেন।
বাল্য থেকে কৈশোরের এই গতিময়তায় কখনো সুখের দেখা মেলা ত দূরের কথা, যেন সে কল্পনাও করে নি।বিয়ের পর সে শ্বশুরালয়ে ছাড়ল সেই সুখের হাফটুকু । তাও আবার মাত্র ছ’বছরের জন্য। কারণ বিয়ের ছ’বছরের ইতিলগ্নেই দীর্ঘ দিন যাবত ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত স্বামী পৃথিবীতে তিনজন উত্তরসূরী রেখে মারা যান। স্বামীর ইন্তিকালের পর শ্বশুর-শাশুড়ীসহ তিন ছেলে নিয়ে বেশ কিছুদিন কাটেপারভীনের।
একমাত্র ছেলের অকাল মৃত্যুতে শোকে শোকে একদিন শাশুড়ী সালেহা খাতুনও ইহমায়া ত্যাগ করেন। এদিকে ছেলে ও স্ত্রীকে হারিয়ে জীবনের বাকি সময়টুকু সুখে কাটাবার জন্যে উজির মুন্সী বাগেরহাটের তাসলিমা নামে এক অর্ধ বয়সী মহিলাকে বিয়ে করেন। তিন ছেলে, শ্বশুর ও সৎ শাশুড়ীকে নিয়ে এখন পারভীনের শুরু হল নতুন পথচলা।
খুলনা জুট মিলে সেকালেরম্যানেজার পদে ছিলেন তাঁর শ্বশুর। সময়ের গতিতে বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে একদিন তাঁর শ্বশুরের চাকুরীর মেয়াদও শেষ হয়ে এল। এখন তিনি রিটার্ডে। সংসার পরিচালনার জন্য উপার্জনকৃত কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে মুদি দোকান দিলেন তিনি। কিছুদিন পর রাতের আঁধারে গাঁয়ের চোর-বদমাইশ প্রকৃতির লোকেরা তাও লুট করে নিল। সারা জীবনের জমানোজায়গা-জমি ও সামান্য ভিটে বাড়ীই এখন তার জীবন পার করার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়।
সৎ ছেলে বউয়ের জন্য সৎশাশুড়ী ঘরে আসা মানে তাঁর চির অশান্তির অনলেপড়া। দুখিনী পারভীনের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হল না। শত বিপদেও বিয়ের পর যেই শ্বশুর তাকে নিজ কন্যাতুল্য মনে করে অদ্যাবধি স্নেহকরে এসেছিলেন, তাঁর আবদার পূরণে ব্রতী ছিলেন; শুধু তাসলিমার কারণে সেই শ্বশুরই আজ তাকে অন্য চোখে দেখেন। তাইতো সংসারের যাবতীয় কাজ করাসহ নিত্যদিন শ্বশুর-শাশুড়ীর খেদমতে ব্যস্ত থাকার পরও তাদের রাগারাগি আর গালমন্দ শুনতে হয় তাকে।
উনিশ শ নিরানব্বই সনের কথা। বন্যা কবলিত সারা গোপালগঞ্জবাসী। বন্যারপানির প্রবল স্রোতের পাশাপাশি পারভীনের প্রতি পারিবারিক নির্যাতনও প্রকট আকার ধারণ করে। ঐ বন্যার একদিনের ঘটনা। শর্তা নিয়ে পারভীনের দশ বছর বয়সী বড় ছেলে রিপনের সঙ্গে সাত বছর বয়সী তাসলিমার কন্যা নূপুরের দুষ্টুমি হয় ।দুষ্টুমির এক পর্যায়ে দু’জনের মাঝে হাতাহাতি হয়। হাতাহাতি দেখে প্রতিশোধের আগুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে তাসলিমা। তাই রিপনের হাতে শর্তা দিয়ে আঘাত করে এর প্রতিফলন ঘটায়।
এতটুকুতেই সে ক্ষ্যান্ত হয় নি। বরং এর কিছুদিন পর বিনা দোষে ছোট ছেলে শাওনকে কাটাযুক্ত খেজুর ডাল দ্বারা পিটিয়ে রক্তে রঞ্জিত করে। এমনিভাবে একইকালে মেঝ ছেলে শিপনের ওপরও শাশুড়ী তাসলিমা কর্তৃক চলে অতর্কিত হামলা। এহেন পরিস্থিতিতে পারভীনের কিছু করার ছিল না। সে শুধু মুখ বুজে সয়ে যায় এ ধরণের শত যন্ত্রনা। ঘর থেকে যেমনিভাবে নির্যাতন পোহাতে হয়, তেমনিভাবে বাইরের পাড়া-প্রতিবেশী কর্তৃকও তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয় অনাবরত।
দেড় বছর হল শ্বশুর মারা গিয়েছেন। নিস্তব্ধ শাশুড়ী। তাঁর থেকে এখন আর নির্যাতনের চিন্তাও করা যায় না। বাহ্যত এখন পারভীন অশান্তির কোপানলে না পড়লেও তাঁরওপর নির্যাতনের প্রক্রিয়াটা পাল্টেছে। ইদানীং গাঁয়ের কিছু উচ্ছৃঙ্খল-লম্পট কর্তকঅমানসিক নির্যাতন চলছে।

পারভীনের বয়স এখন ত্রিশোর্ধ। জীবন সায়াহ্নে দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে এই দুখিনীর আকুতি এই যে, ‘ছেলেবেলা হতে এ পর্যন্ত আমি বহু কষ্ট স্বীকার করেছি। আমায় আর কষ্ট দিও না। শরীরে আর যন্ত্রনা সয় না। তাই জীবনের এ অন্তিমকালে আমাকে ঐসব দুশ্চরিত্র-লম্পটদের হাত থেকে উদ্ধার করুন। আমি সম্মানের সঙ্গে শেষসময়টুকু পাড়ি দিতে চাই।


   যেমন কাজ করবে/তেমনই ফল পাবে/বিশ্বাস হয়না ?তো করে করে দেখ/-/জান্নাত আছে/জাহান্নামও আছে/বিশ্বাস হয়না ?তো মরে দেখ !


0 comments

Post a Comment

Thanks for comment